News71.com
 Bangladesh
 22 Apr 20, 01:04 PM
 2964           
 0
 22 Apr 20, 01:04 PM

করোনার দাপটে কর্মচঞ্চল ডুমুরিয়া পরিনত হয়েছে প্রানহীন সুনশান নীরব জনপদে॥

করোনার দাপটে কর্মচঞ্চল ডুমুরিয়া পরিনত হয়েছে প্রানহীন সুনশান নীরব জনপদে॥

এস এম শাকিলুর রহমানঃ করোনার কূ-প্রভাবে খুলনা বিভাগের বৃহদ জনপদখ্যাত কর্মচঞ্চল প্রানবন্ত ডুমুরিয়া পরিনত হয়েছে কর্মহীন, প্রানহীন, সুনশান নিরব জনপদে। ১৪ টি ইউনিয়ন ও ৬টি বড় মোকাম নিয়ে গঠিত এই উপজেলা সদরের বাজারের সকল অফিস , ব্যাংক-বিমা, দোকানপাট সবকিছুই বেশকিছুদিন ধরে বন্ধ । বর্তমানে একদমই জনমানবহীন হয়ে পড়েছে খুলনা মহানগরীর সন্নিকটে অবস্থিত এই ব্যস্ত উপশহর। খুলনা শহরের লাগোয়া হওয়ায় এই উপশহর তাজা মাছ ও টাটকা সবজীসহ নানান কৃষি পন্যের একটি প্রসিদ্ধ মোকাম বটে। কিন্ত সবকিছুই আজ পডে আছে পরিত্যক্ত মৃতপ্রায় ভুতুডে বাড়ির মতই পড়ে আছে। মানুষের পদচারনা না থাকায় সবখানে জমেছ ময়লার ভারী স্তুপ। বয়জেষ্ঠরা বলছেন ডুমুরিয়া বাজারের এখনকার দৃশ্য ১৯৭১ সালের নীরবতাকেও হার মানায় । কারন তখন মানুষ পাকিস্তানি হানাদারদের ভয়ে (খান সেনাদের) ঘরে লুকিয়ে থাকত বা আত্মগোপনে থাকত । আর এবার ঘরবন্দি হয়ে আছে মহামারি করোনা ভাইরাসের সংক্রমন থেকে আত্মরক্ষা বা জীবন বাঁচানোর জন্য।

১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সালে হানাদার পাকিস্তানিরা মানুষকে হত্যা করত মুলত তাদের ধর্ম ও রাজনৈতিক বিশ্বাস বিবেচনা করে। কিন্ত এই মুহূর্তের বিশ্বত্রাস খ্যাত করোনা ভাইরাস তো ধনী, গরীব, ধর্ম, বর্ন , নেতা, জনতা কোন কিছুরই তোয়াক্কা করছে না। কাছাকাছি বা সংস্পর্শে আসার মাত্রই কয়েক সেকেন্ডে কাছে আসা ব্যক্তি বা বস্তুকে গ্রাস করে ফেলছে এই ঘাতক ভাইরাস । আর ধীরে ধীরে মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর দিকে। তাই একটা অজানা আতঙ্কের মধ্যেই অনেকটা মৃত্যুকে হাতে নিয়েই মানুষকে ঘরবন্দি হয়ে অলস সময় কাটাতে হচ্ছে। বাইরে যাওয়ার সুযোগ পেলেও মৃত্যুভয়ে শঙ্কিত থাকতে হচ্ছে সারাক্ষন। দশবার ভাবতে হচ্ছে বাইরে যাবে কিনা । ভয়াবহ এই মানবিক বিপর্যয়ে সবচেয়ে বিপদে আছে দরিদ্র নিন্ম আয়ের মানুষগুলো। প্রতিদিন কাজ না করলে যাদের ঘরে চুলা জ্বলে না তারা আছেন পরিবার পরিজন নিয়ে চরম বিপদে। হঠাৎ কর্মহীন হয়ে পড়া এই মানুষদের দুবেলা খাবার আশায় তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে বিভিন্ন প্রকার সাহায্য বা ত্রানের দিকে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে মাঝে মাঝে তাদের সামান্য সাহায্য মিললেও প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই সামান্য বা অপ্রতুল। বেশীরভাগ দরিদ্র মানুষই থেকে যাচ্ছে সুবিধাভোগীদের বাইরে। আর নিন্মমধ্যবিত্তদের কথা তো বলাই বাহুল্য। তারা না পারছে লাইনে দাঁড়িয়ে হাতপেতে সাহায্য নিতে আর না পারছে সঠিকভাবে পরিবার পরিজনের মুখে খাবার তুলে দিতে। এক কথায় চরম হতাশা আর উৎকন্ঠার মধ্যে চরম মানবেতর জীবন যাপন করছে এই মানুষগুলো।

উল্লেখ্য করোনা ভাইরাসের সংক্রমনের আগে ডুমুরিয়া সদরে প্রতিদিন নিয়মিত বাজেরের পাশাপাশি প্রতি শুক্রবার এবং সোমবার দু’দিন সাপ্তাহিক হাট বসত। যেখানে সদরসহ আশেপাশের প্রায় সকল এলাকার কৃষকেরা তাদের নিজেদের উৎপাদিত ফসলের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ব্যবসায়িরা তাদের পন্যের পসরা সাজিয়ে বসত বিক্রির জন্য। আর চাকুরীজীবি, ব্যবসায়ি , শ্রমজীবি, দিনমজুর , সবাই তাদের পছন্দ মতো চাল, ডাল, শাকসবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস বা সামগ্রী কিনত। সপ্তাহে এই দুইটা দিন যেন ছিল ডুমুরিয়াবাসির জন্য মিলনমেলার দিন। কারনে অকারণে বাজার করার উছিলাতে অনেক হাটে এসে আত্মীয় স্বজন, প্রিয়জন ও পরিচিত বন্ধুজনের সাথে মিলিত হত। কিন্তু মহামারি করোনার (COVID-19) প্রভাবে আজ সে জাকযমকপূর্ন বাজার পরিনত হয়েছে নিস্তব্ধ প্রাণহীন মৃত এক নগরীতে। যেখানে আগে প্রতিদিন কমবেশী অর্ধলক্ষ মানুষ এর সমাগম বা আনাগোনা ছিল, সেখানে আজ সারাদিন অর্ধশত মানুষেরও দেখা পাওয়া দুষ্কর।

বর্তমানে খুব বেশি জরুরী প্রয়োজন না হলে এখন আর কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। তারপরও জরুরী প্রয়োজনের তাগিদে যারা বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন তারা অনেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া প্রশ্নের মুখে আবার ঘরে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। যে খুলনা-সাতক্ষিরা হাইওয়েতে আগে প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রীবাহী ও মালবাহী ভারি গাড়ি চলাচল করত আজ সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ২/১ টি গাড়ি আর এ্যাম্বুলেন্স ছাড়া আর কোন যানবাহনই চোখে পড়ে না। আর বাজারের দোকান, ব্যাংক,বীমা, পোস্ট অফিস বন্ধ থাকার কারনে তার প্রভাব পড়েছে এই অন্চলের গ্রামীণ অর্থনীতিতে। যেখানে আগে প্রতিদিন কোটি টাকার লেনদেন হতো, তা আজ সম্পুর্ণ অচল হয়ে পড়ে আছে। বেচা বিক্রির অভাবে ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে কৃষকের বিভিন্ন প্রকার মৌসুমি কাঁচা সবজি ও ক্ষেতের ফসল। যদিও স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে মানুষের কিছু জরুরী নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দোকান সকাল ৮টা হতে বিকাল ৪ টা পর্যান্ত খোলার অনুমতি দিয়েছে যা প্রোয়জনের তুলনায় অনেক কম। সরবরাহ কম থাকায় তা আবার চড়া দামে কিনতে মানুষকে। আর সন্ধ্যার আগে সকল দোকান বন্ধ হওয়ার জন্য সকল রাস্তা ঘাট ফাকা হয়ে যায়। সন্ধ্যার পর এই বাজার এতটাই জনমানবহীন বাজারে পরিনত হয় যে যাতে চুরি ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধ সংগঠিত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই নিরাপত্তার জন্য বাজার পরিচালনা কমিটি নৈশ প্রহরা বা ডিউটির ব্যবস্থা করেছে।

কৃষি বিভাগের দেয়া তথ্য অনুযায়ি খুলনা বিভাগের সিংহভাগ ধান উৎপাদন হয় এই ডুমুরিয়া উপজেলা এলাকাতেই। এই এলাকার কৃষকদের উৎপাদিত ধান দিয়েই খুলনা বিভাগের খাদ্য চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি সরকার ক্রয় করে গোটা দেশে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। আর এখন ডুমুরিয়াতে শুরু হয়েছে গ্রীষ্মকালীন ধান কাটার মৌসুম। এই এলাকার বিপুল পরিমাণ চাষাবাদকৃত জমির ধান কটার জন্য প্রচুর পরিমান কৃষি শ্রমিকের দরকার। কিন্তু লকডাউন এর ফলে এই কাজে জনবলের চরম সংকটও দেখা দিয়েছে। ফলে কৃষকরা তাদের এই মাঠভরা পাকা ফসল নিয়ে যথেষ্ট চিন্তায় মধ্যে রয়েছেন। তারউপর এখন বৈশাখ মাস, এ মাসে বাংলাদেশে কালবৈশাখী ঝড় সহ বড় ধরনের প্রাকৃতিক দূর্যোগ দেখা দেয়। বর্তমানে আবহাওয়ার অবস্থাও বিশেষ ভাল না। কৃষি বিভাগ থেকে বার বার তাগিদ দেয়া হচ্ছে পাকা ধান কেটে দ্রুত ঘরে তোলার জন্য। কিন্ত পর্যাপ্ত কৃষি শ্রমিকের অভাবে সে কাজ মারাত্মকভাবে ব্যহত হচ্ছে । ক্ষেতেই নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে কৃষকের পাকা ধান। আর তাতেই রাতের ঘুম হারাম হয়েছে কৃষকের। এত পরিশ্রম ও টাকা ব্যায় করে ফসল ফলানোর পর যদি তা নির্বিঘ্ন ঘরে না তোলা যায় তাহলে পরিবার পরিজন নিয়ে পথে বসতে হবে কৃষকদের। ফসল নষ্ঠ হলে একদিকে যেমন খাদ্য সঙ্কটে পড়তে হবে তেমনি অপরদিকে চড়া সুদে নেয়া এনজিও ও মহাজনের দেনা শোধ না করতে না পেরে বসত বাড়ি জায়গা জমি হারিয়ে পথে বসতে হবে কৃষকদের।

Comments

নিচের ঘরে আপনার মতামত দিন