News71.com
 Bangladesh
 15 May 16, 03:32 PM
 807           
 0
 15 May 16, 03:32 PM

ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে বিলীন হয়ে যাচ্ছে প্রমত্তা পদ্মা।। কমেছে দেশের দক্ষিনাঞ্চলের নদ-নদীর মিঠা জলের প্রবাহ

ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে বিলীন হয়ে যাচ্ছে প্রমত্তা পদ্মা।। কমেছে দেশের দক্ষিনাঞ্চলের নদ-নদীর মিঠা জলের প্রবাহ

নিউজ ডেস্কঃ বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে গঙ্গার জল বিষয়ে ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তির ১৯ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। এ বছর জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত শুস্ক মৌসুমে ফারাক্কা ব্যারেজ দিয়ে বাস্তবে চুক্তিমাফিক জলের প্রবাহ নজরে আসেনি। এপ্রিল-মে মাসকে চুক্তির শর্তে শুস্ক মৌসুম ধরে ভারতের ফারাক্কা পয়েন্টে জলের প্রবাহ যাই থাক তা কোনভাবেই বাংলাদেশের পদ্মা নদীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে ৩৪ হাজার কিউসেকের নিচে কমবে না। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। পদ্মা নদীতে জল স্বল্পতার কারণে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে মরুকরণ অবস্থা স্থায়ী রুপ নিতে যাচ্ছে।

বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসে দিনে প্রচন্ড তাপদাহ আর গভীর রাতে শীতকালের মতো আবহাওয়া অনুভব করছে মানুষ। যা মরু আবহাওয়ার লক্ষণ বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। জীববৈচিত্র্য হুমকীর মুখে পতিত হয়েছে অনেক আগেই। পদ্মা পাড়ে এখন আর গাঙচিল বেলেহাঁস আর ধবল দেখা যায় না। দৃষ্টিতে আসে না অন্যান্য পাখি। নদীতে পর্যাপ্ত জল না থাকায় মাছ শুন্য প্রায় পদ্মা।

আন্তর্জাতিক নদী পদ্মা (গঙ্গা) উজানে ভারত বাঁধ দিয়েছে। ফারাক্কা ব্যারেজ দিয়ে ভাগিরথী নদীর মাধ্যমে জলের প্রবাহ ঘুরিয়ে নিয়েছে। ফারাক্কার উজানে জল থৈই থৈই করছে। ভাটির সময় বাংলাদেশে ক্রমেই তীব্র জল সঙ্কটে নিপতিত হচ্ছে। কালক্রমে প্রমত্তা পদ্মা নদীর সাথে প্রধান শাখা আত্রাই, গড়াইসহ ৮৫টি নদ-নদীতে জলের টান পড়তে শুরু করে। এর সুদুর প্রসারি প্রতিক্রিয়ায় নেমে গেছে ভূগর্ভস্থ জলের স্তর। খাল বিল শুকিয়ে গেছে।

ফারাক্কার কারনে যশোর-খুলনা অঞ্চলে মিঠাজলের প্রবাহ কমে গেছে। পদ্মার তলদেশ ওপরে উঠে এসেছে। নদীর জীবনচক্র ধ্বংস হয়ে গেছে। জলজপ্রাণী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এখন পদ্মায় তেমন ইলিশ পাওয়া যায় না। ইলিশের বিচরনক্ষেত্র ছিল রাজশাহী থেকে পাবনা পর্যন্ত। মাছ আসার জন্য জলে যে পরিমান প্রবাহ থাকার কথা সেটি না থাকায় এখন আর পদ্মায় ইলিশ আসে না। গাঙ্গেয় জল ব্যবস্থায় দুই শতাধিক প্রজাতির মিঠাজলের মাছ ও ১৮ প্রজাতির চিংড়ি ছিল। সেগুলোর অধিকাংশই এখন বিলুপ্তির পথে। ফলে নদী ও ভূগর্ভের জল দিয়ে সেচ কার্য ব্যাহত হয়ে পড়ে। চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর পদ্মা নদীর বুকে চুক্তি মাফিক জল আসেনি। এখনও জল পাওয়া যায় না। যদিও হাইড্রোলজি পাবনা অফিস চুক্তির পর থেকে জল প্রবাহের কোন তথ্য সাংবাদিকদের দিচ্ছে না। জিজ্ঞেস করলে বলা হয়, যৌথ নদী কমিশন দিতে পারবে। পদ্মা নদীর কোন কোন স্থানে হেঁটেই পার হওয়া যায়। আর জল প্রবাহ চুক্তির শর্ত মাফিক সঠিক থাকলেও পদ্মা ও এর শাখা নদীর দুরাবস্থায় পড়ার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে সেইটাই হচ্ছে।

দেশের মানুষ এবং বিশেষ করে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ দেখছেন, নদী শুকিয়ে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। পদ্মা নদীতে পর্যাপ্ত জল না থাকায় এর প্রধান শাখা নদী আত্রাই ও গড়াই নদীতে জলের টান পড়েছে। গড়াই নদীর কষ্টিয়া কয়ারা ব্রিজের নিচে বালু চর। জিকে প্রজেক্ট কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে। পদ্মা, মধুমতি, নবগঙ্গা, কাজলা, মাথাবাঙ্গা, গড়াই, আত্রাই, চিকনাই, হিনসা, কুমার, সাগরখালি, কপোতাক্ষ, চন্দনাসহ পদ্মার ৮৫টি শাখা-প্রশাখা নদীর বুকে জেগে উঠেছে ছোট-বড় অসংখ্য চর। কোন কোন স্থানে বালু স্থায়ী মৃত্তিকায় রুপ নেওয়ায় ফসল আবাদ করেছেন অনেকেই। বর্তমানে পদ্মা নদী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ সড়ক সেতুর নিচে খাস জমিতে স্থানীয় কৃষক চিনা বাদাম, আখ ও রবি শস্য আবাদ করেছেন। চিনা বাদাম উত্তোলন শেষ হয়েছে। বর্ষা মৌসুমের আগেই অন্যান্য ফসল ঘরে তুলতে চাচ্ছে কৃষক। কারণ, আষাঢ়-শ্রাবণ মাস শুরু হলে পদ্মা নদীতে জল বেড়ে যাবে। এই সময় ফারাক্কার কয়েকটি গেট খুলে দেওয়া হলে পদ্মা নদীর গভীরত্ব কমে যাওয়ায় বণ্যা দেখা দেবে।

বাংলাদেশ-ভারত গঙ্গা নদীর জল বন্টন চুক্তি ১৯৯৭ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার পর জল সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌছে যায়। ১৯৯৬ সালের ১২ই ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবে গৌড়া গঙ্গা নদীর জল বন্টন সংক্রান্ত ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ৩০ বছর দীর্ঘ মেয়াদী এই চুক্তিতে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে তীব্র শুষ্ক সময়ে বাংলাদেশ ৩৫ হাজার কিউসেক জল পাবে। এতে প্রতি ১০ দিনকে একটি ব্লক হিসেবে গন্য করা হয়েছে। এই ব্লক ১লা মার্চ থেকে ৩১শে মে পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। চুক্তিপত্রে এনেক্স ১ এ গ্যারান্টি ক্লজ সংযুক্ত করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে প্রতি ১০ দিন পর পর ভারত ও বাংলাদেশ ৩৫ হাজার কিউসেক জল অবশ্যই পাবে। গ্যারান্টির এই বিধানটি ১লা মার্চ থেকে ১০ই মে সময়কাল পর্যন্ত। ফারাক্কা পয়েন্টে জলের প্রবাহ ৫০ হাজার কিউসেক এর কম দেখা গেলে দুই দেশের সরকার তাৎক্ষনিক ভাবে জরুরি ভিত্তিতে আলোচনা করে সমন্বয় সাধন করতে পারবে বলা হলেও কার্যত কিছুই হচ্ছে না। ভারত তার দাদাগিরি মনোভাব বজায় রেখেছে।

অনুচ্ছেদ-২ এ বলা হয়েছে উভয় পক্ষ থেকে সমান সংখ্যক সদস্য নিয়ে একটি যৌথ কমিটি গঠন করবে। এই কমিটি ফারাক্কা পয়েন্ট হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকা ও ফিডার ক্যানেল এলাকায় জলের প্রবাহ পর্যবেক্ষণের জন্য একটি টিম নিয়োগ করবে। এই টিম উভয় সরকারের কাছে জল প্রবাহের সংগৃহীত ডাটা-উপাত্ত পেশ করবে। তা যদি করত তাহলে পদ্মায় জল প্রবাহ থাকত। কিন্তু প্রতি বছরই বাংলাদেশ জল পেয়েছে চুক্তির অনেক কম। পদ্মার প্রধান শাখা নদী হলো আত্রাই, মাথাভাঙ্গা, কুমার, ইছামতি, গড়াই, আড়িয়ালখা প্রভৃতি। প্রশাখা হলো মধুমতি, পশুর, কপোতাক্ষ। উপনদী একটি মহানন্দা। মহানন্দা রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী থানায় পদ্মায় মিলিত হয়েছে। পদ্মার জল দিয়ে শুকনো মৌসুমে রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর প্রভৃতি জেলায় সেচকাজ চালানো হয়। এ নদীর জল দিয়ে প্রায় ২০ ভাগ জমির সেচকাজ চলে।

বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বানিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পদ্মা নদীর ভুমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পাবনার মধ্য দিয়ে পদ্মার আর একটি শাখা নদী মরা পদ্মা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে মূল পদ্মা, গড়াই এবং পাবনার চাটমোহরের বড়াল, ছোট যমুনা, পূনভবা, আত্রাই, ইছামতি, গুমানী, গোমতী, ভদ্রবতী, গোহালা, নন্দকুজা, গাড়াদহ, কাকন, কানেশ্বরী, সরস্বতী, মুক্তাহার ঝবঝবিয়া, ফুলজোর এলাকা ঘুরেদেখা যায় এসব নদীর অস্তিত্ব হারিয়ে যাচ্ছে। পদ্মা নদীতে জলের প্রবল টান পড়ায় এই সব নদী শুকিয়ে গেছে। কোন কোন স্থানে হাটু পর্যন্ত জল আছে। এলাকারপ্রবীণ লোকদের মতে, ফারাক্কা ব্যারেজের আগে এই সব নদ-নদীতে সারা বছর জল থাকতো। অপর দিকে তিস্তা নদীতে জল না থাকায় ব্রহ্মপুত্র নদে জলের টান পড়ায় যমুনা নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। পাবনা নগরবাড়ী, বেড়া-নাকালিয়া যমুনা নদীর বুক জুড়ে অসংখ্য ছোট বড় চর । বেড়ার নিকটবর্তী শাহজাদপুরে বাঘাবাড়ি ব্রিজের নিচে বড়াল নদীতে অসংখ্য চর পড়েছে। বড়াল নদীর নাব্য কমে যাওয়ায় রাসায়নিক সারবাহী জাহাজ বাঘাবাড়ী বন্দরে ভিড়তে অসুবিধার মধ্যে পড়ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নদী বিশেষজ্ঞ কামরুন নেছা জানান, বাংলাদেশের পদ্মার যে বিপুল আয়তন তাতে স্বাভাবিক প্রবাহ থাকলে প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টির কথা উঠতো না। কিন্তু ভারত নেপালের কোশি থেকে শুরু করে ফারাক্কা পর্যন্ত সুদীর্ঘ পথে জল প্রত্যাহারের যে একতফা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে- তাতে বাংলাদেশের বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে।

Comments

নিচের ঘরে আপনার মতামত দিন