আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ লাল মাটির দেশ বীরভূমের বোলপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সব কর্মযজ্ঞ। পরবর্তীতে যুক্ত হয়েছে নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের নাম। তিনিও এই বোলপুরেরই সন্তান। তবে গত ৫ বছর ধরে বীরভূমে যত চর্চা সব আরেক বোলপুরবাসী অনুব্রত মন্ডলকে ঘিরে। বীরভুমের তৃণমূল কংগ্রেসের এই জেলা সভাপতিকে অবশ্য দলনেত্রী কেষ্ট বলেই ডাকেন। এই কেষ্টর মাথায় যে অক্সিজেন বিশেষ যায় না সে কথাটাও মমতাই সকলকে জানিয়েছেন। তাই বিশালাকায় বপুর কেষ্টকে সবসময় অক্সিজেন সঙ্গে করে ঘুরতে হয়। তবে তার এই অসুস্থতার জন্য তিনি সংবাদ মাধ্যমের শিরোনামে মোটেই নন। তার সর্বগ্রাসী দাপটেই তিনি শিরোনামে গত পাঁচ বছর ধরে। নির্বাচন এলেই এই কেষ্টর দাপট ও হুমকি বেড়ে যায় শতগুনে।
রবিবারই বীরভূমের ১১টি আসনে নির্বাচন। এই ১১টি আসনই মমতা দিদির হাতে তুলে দেবার অঙ্গীকার করেছিলেন দিদির কেষ্ট। গত একবছরে কেষ্টর বাহিনীর আক্রমণে ২৫ জন নিহত হয়েছেন এই জেলায়। অবশ্য সবই রাজনৈতিক সংর্ঘষের কারণে । গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে বোলপুর মহকুমার বেশির ভাগ জায়গাতেই বিরোধী সিপিআইএম কোনো প্রার্থী দিতে সাহস করে নি। এমনকি তৃণমূল কংগ্রেসেরই এক সদস্য সাগর ঘোষ দলের মনোনয়ন না পেয়ে অনুব্রতের কথা অগ্রাহ্য করে নির্দল হিসেবে লড়তে চেয়ে প্রাণ দিয়ে দিতে হয়েছে তাকে । এবারের নির্বাচনের কদিন আগেই অনুব্রত ম্যাজিসিয়ানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বলেছেন, নির্বাচনের দিন বীরভুমের সব বুথ থেকে বিরোধীদের পোলিং এজেন্টকে তিনি ভ্যানিস করে দেবেন। এসব ছাড়াও নানা অকথ্য ভাষায় তার জুড়ি মেলা ভার। ভোটের অনেক আগে থেকেই অনুব্রতের সোজা হুমকি ছিল, বিরোধীরা লড়তে গেলে তাদের হাত-পা ভেঙে দেয়া হবে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হবে। এমনকি পুলিশ বাধা দিলে তাদেরও হাত-পা কেটে নেয়া হবে। এমনকি ভাতে মারার ব্যবস্থাও করে রেখেছেন এই কেষ্ট। আদিবাসীদের জানানো হয়েছে, ভোট না দিলে একশ দিনের কাজের বরাতও মিলবে না। আর ক’দিন আগেই তিনি ময়ূরেশ্বরের বিজেপি প্রার্থী অভিনেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে এমন সব কথা বলেছেন তা মিডিয়াতেও আনা যাচ্ছে না। অবশ্য এসবেই দিদির আশীর্বাদ রয়েছে কেষ্টর মাথায়। কেষ্ট যে হুমকি দিয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করতে পারেন। শূন্য বুথকে পূর্ণ করে দিতে পারেন তার বাহিনী দিয়ে। এসব নিয়েই বিরোধীরা ক্রমাগত অভিযোগ জানিয়েছে নির্বাচন কমিশনের কাছে। সর্বশেষ তাকে গ্রেপ্তারের দাবিও জানিয়েছেন বিরোধী দলের নেতারা। ইতিমধ্যেই নির্বাচন কমিশন অনুব্রতকে তার কর্মকান্ডের জন্য ভর্ৎসনা করেছে। তবে বিরোধীদের মিলিত চাপে বাধ্য হয়েই নির্বাচন কমিশন অনুব্রতকে নিয়ে অন্যরকম দাওয়াই দিয়েছে।
গত শুক্রবার সন্ধ্যায় দিল্লির নির্বাচন সদন থেকে বার্তা এসেছে যে, একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে অনুব্রতর উপর সর্বক্ষণ নজরদারি চলবে। তাকে ঘিরে রাখবে কেন্দ্রীয় বাহিনী। একজন ভিডিওগ্রাফার সারাক্ষণ নজরদারির ছবি ক্যামেরাবন্দি করবেন। নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত এই নজরদারি চলবে। এই নির্দেশ মতো আজ সকালে তার বাড়ির সামনে পৌঁছে গিয়েছেন নজরদারি দল। নির্বাচন কমিশনের জনসংযোগ অধিকর্তা ধীরেন্দ্র ওঝা বলেছেন, নির্বাচন চলাকালীন অনুব্রত মন্ডলের গতিবিধি এবং নির্বাচন সংক্রান্ত কার্যকলাপ নজরে রাখতেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে অনুব্রতকে নিয়ে নির্বাচন কমিশনের এই ব্যবস্থায় যে বিরোধীরা খুশি তা মোটেই নয়। অনেকের মতে, একমাত্র এফআইআর করে গ্রেপ্তারই ছিল অন্যতম পথ। বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের মতে, ভোটের ঠিক ২৪ ঘন্টা আগে এই ব্যবস্থা তেমনভাবে ভোট সন্ত্রাস ঠেকাতে পারবে বলে মনে হয় না। কেন না, অনুব্রত ইতিমধ্যেই তার বাহিনীকে দায়িত্ব দিয়েছেন ভোট লুঠের পথ ঠিক রাখতে। তবে বীরভূমের শিক্ষক থেকে শুরু করে একজন ছা-পোষা মানুষের সঙ্গে কথা বলে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, সন্ত্রাসমুক্ত পরিবেশে এবং ভোটাররা যদি সাহস করে ভোট কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারেন তাহলে বীরভূমের অনেক আসনই চলে যাবে বাম-কংগ্রেস বিরোধী জোটের হাতে। গত নির্বাচনে বীরভূম থেকে তৃণমূল কংগ্রেস জিতেছিল ৬টি আসনে। পরে কংগ্রেস থেকে একজনকে ভাগিয়ে এনে হয়েছিল ৭। আর সিপিআইএমের দখলে ছিল ৩টি আসন। কংগ্রেস ২টি আসনে জিতলেও পরে তা কমে এসেছিল ১টিতে।
উল্লেখ্য, বীরভূম চিরকালই লাল দুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল। ২০১১ সালের পরিবর্তনের হাওয়ায় লাল দুর্গ লন্ডভন্ড হয়ে গেলেও এবার বামরা অনেকটাই সাহস করে মাঠে নেমেছেন। সঙ্গে পেয়েছে কংগ্রেসকে। ফলে নতুন ভোট সমীকরণে ফল অন্যরকম হলেও আশ্চর্য্যরে কিছু থাকবে না। অবশ্য অনুব্রতর ভ্যানিস ম্যাজিক কতটা কাজ করবে তার উপর নির্ভর করছে সব কিছু।