নিউজ ডেস্ক: অবশেষে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে নাইজেরিয়ার জেল থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরছেন বাংলাদেশি চার নাবিক ও প্রকৌশলী। তাদের অপেক্ষায় প্রহর গুণছেন স্বজনরা। প্রায় আড়াই লাখ মার্কিন ডলার আর্থিক দণ্ড দিয়ে ১৫ মাস ধরে দেশটির জেলে আটকে থাকা এই চার বাংলাদেশি তরুণকে মুক্ত করে আনা হচ্ছে।
আজ সোমবার বিকেলে এদের তিনজন দেশে পৌঁছাবেন। আটক অন্যজনও আগামী সপ্তাহের মধ্যেই দেশে ফিরতে পারবেন বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য তৃতীয় প্রকৌশলী মুজাহিদুল আজিম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এসব বাংলাদেশিরা হলেন- সাতক্ষীরার জি এম শাহীনুল ইসলাম, কুষ্টিয়ার শিবলী নোমান, ময়মন সিংহের জহিরুল ইসলাম ও জামালপুরের রফিকুল ইসলাম। শিবলী নাবিক, জহিরুল প্রধান কর্মকর্তা এবং রফিকুল ও শাহীনুল জাহাজের তৃতীয় প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
সোমবার বিকেলে প্রধান কর্মকর্তা জহিরুল বাদে বাকি তিনজনকে দেশে আনা হচ্ছে। তবে জহিরুলের মুক্তির অর্থও জমা পড়েছে। শিগগিরই তিনি দেশে ফিরবেন।
চার নাবিকের মোট ২০ বছরের কারাদণ্ড এড়াতে আদালতের দেওয়া অর্থদণ্ড পরিশোধের বিষয়ে বাংলাদেশের মেরিনারদের পক্ষ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া যায়। ম্যানিং এজেন্টের অনুদান, সরকারি সাহায্য এবং মেরিন ফিশারিজ একাডেমি এক্স ক্যাডেট ইঞ্জিনিয়ার রশিদ এবং তাদের অ্যাসোসিয়েশনের মিলে এ অর্থের সংস্থান করেছে বলে জানা যায়।
আটক নাবিকদের উদ্ধারে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের ডাকে সাড়া দিয়ে আরও এগিয়ে আসেন মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ক্যাপ্টেন জিল্লুর রহমান ও বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির কিছু সদস্য।
এছাড়া ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকা, এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার প্রবাসী মেরিনারদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখেন মেরিন একাডেমির ১৮তম ব্যাচের ক্যাডেট সিঙ্গাপুর প্রবাসী মেরিন চিফ ইঞ্জিনিয়ার বাতেন।
জানা যায়, জনপ্রতি প্রায় ৫৫-৬৫ হাজার মার্কিন ডলার অর্থদণ্ড দিয়ে তাদের মুক্ত করে আনা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে ২০ লাখ টাকার মতো সহায়তা দেওয়া হয়।
রোববার মুজাহিদুল আজিম বাংলানিউজকে বলেন, ‘সোমবার বিকেল পাঁচটা ২০ মিনেটে তিন বাংলাদেশি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌঁছাবেন। আটক বাংলাদেশির টাকাও পরিশোধ হয়ে গেছে। তার মুক্তির বিষয়েও আমরা নিশ্চিত।’
জানা যায়, গত ২০১৫ সালের মার্চ মাসে গ্রিসের পতাকাবাহী একটি জাহাজ মেরামতের জন্য বেনিন বন্দরের ১০০ মাইলের মধ্যে রাখা ছিলো। চার বাংলাদেশি ওই জাহাজটিতে কর্মরত ছিলেন। জাহাজটিকে নাইজেরিয়ার নৌ বাহিনী নিজেদের সমুদ্রসীমায় নিয়ে তল্লাশি চালায়। প্রায় সাড়ে তিন হাজার টন জ্বালানি তেল থাকা জাহাজটির ক্যাপ্টেন এ সময় জাহাজের বৈধ কাগজপত্র দেখাতে ব্যর্থ হন। এছাড়া জাহাজে চোরাই তেল ছিলো বলে দেশটির আদালতে প্রমাণিত হয়।
জাহাজটির বৈধ কাগজপত্র না থাকার কারণে এটিতে থাকা মোট ২১ জনের মধ্যে বাংলাদেশ ও ফিলিপাইনের ৯ নাবিক ও প্রকৌশলীকে জেল ও জরিমানা করা হয়। যদিও ক্যাপ্টেনসহ অন্যান্য উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কোনো ধরনের শাস্তি না পেয়েই বের হয়ে যায়।
নাইজেরিয়ায় বাংলাদেশের কোনো দূতাবাস না থাকায় কেনিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস এ চার বাংলাদেশিকে তরুণকে মুক্ত করার প্রক্রিয়াটি দেখভাল করে। দূতাবাসের পক্ষ থেকে ইতা সাহা নামে একজন বাংলাদেশিকে এ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ব্যবসায়ী ইতা নাইজেরিয়াতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।
এই তিন বাংলাদেশিকে নাইজেরিয়ার আদালত থেকে একসঙ্গে মুক্ত করা সম্ভব হয়নি। জনপ্রতি অর্থদণ্ড পরিশোধের পর এক একজনকে মুক্ত করা হয়। মুক্তি পাওয়া তিনজন ইতা সাহার কাছেই ছিলেন। সেখান থেকেই দেশে ফিরছেন তারা।
গত বছরের মার্চে জাহাজটি আটক হওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগেই এসব বাংলাদেশি জাহাজটিতে যোগ দেন। ঘটনার পর জাহাজের মালিক আটকৃতদের মুক্ত করতে কোনো ধরনের সহযোগিতাই করেনি বলে জানায় জাহাজটির বাংলাদেশ প্রতিনিধি।
কেনিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মাত্র কয়েকদিন চাকরি করেই এসব বাংলাদেশি আটক হন। জাহাজটি বৈধ না অবৈধ, তাতে কী ধরনের পণ্য রয়েছে- এসব তথ্য ওই চার জনের জানা কথা নয়। তাই এসব বাংলাদেশি কোনভাবেই দোষী নয়। কাগজপত্রের বৈধতা সম্পর্কে জানার কথা জাহাজ মালিকের। অথচ নাইজেরিয় কর্তৃপক্ষ তাদের কাউকেই সাজা দেয়নি।
এ কারণে অর্থদণ্ড মুক্তি পেলেও তাদের সাজার বিরুদ্ধে নাইজেরিয়ার আদালতে আপলি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন।
এ প্রসঙ্গে জাহাজিটির বাংলাদেশের প্রতিনিধি আবুল খায়ের বলেন, আপিলে জয়ী হলে পরিশোধ করা এ অর্থ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা আপিলে জয়ী হওয়ার আশাবাদী। কারণ, জাহাজের টেকনিক্যাল বিষয়গুলোর জন্য উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দায়ী, এসব বাংলাদেশি কর্মচারী নন।
এদিকে, দীর্ঘ সময় কারাবাসের কারণে এ চার নাবিক শারীরিক ও মানসিকভাবে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থাও বেশ নাজুক হয়ে এসেছে। তবে তাদেরকে সুস্থ করে আবারও কাজে ফেরাতে অর্থাৎ তাদের পুনর্বাসনের জন্য বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অ্যাসোসিয়েশন উদ্যোগ নেবে বলে জানানো হয়।